আমার ক্ষণ গণনা চলছে। একসময়ের বিবিসি রেডিও শোনার মতো বলতে হচ্ছে, এখন রাত বারটা বেজে এক মিনিট। আজ ২৫ জুন ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ, ১১ আষাঢ় ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, রোজ শনিবার, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য হাজার বছরের সেরা দিন।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের মহান বিজয় দিবসের পরবর্তী সময়ে জাতীয় জীবনে বয়ে চলা একান্ন বছরের অন্যতম সেরা দিন আজ। আমাদের স্বপ্ন পূরণের দিন, আমাদের মাইল ফলক অর্জনের দিন, আমাদের উদ্ভাসিত হবার দিন। উদযাপনের দিনও বটে!
আমরা যারা মফস্বলের এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের অধিবাসী, কী নিদারুণ দুঃখকষ্টে পথে পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন পার করেছি। হয়তো তা অতীত, কিন্তু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার কণ্টকময় দিনগুলো কী স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা যাবে!
পদ্মা সেতু কোনো সেতু না, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই খরস্রোতা পদ্মার সংহার মূর্তির প্রতীকে নৈবদ্য দিয়ে পোষ মানানো এক জ্বলন্ত মিথ, মানুষের মেধা ও কারিগরি জ্ঞান-বিদ্যায় সৃষ্ট জেগে থাকা অবয়ব। কোনো বিতর্ক না, কোনো আপোষ না, কারো করুণায় নতজানু হওয়া না, আসুন আমাদের অহংকারের ধনকে প্রণয়মাখা চওড়া বুকে ধারণ করি। আমরা একেকজন হয়ে উঠি সুলতানের ক্যানভাস, ধন ধান্যের পুষ্টিতে ভরে উঠুক আমাদের পেশি।
একজন প্রাক্তন রেলকর্মী হিসেবে আমাদের গর্ব, বাংলাদেশ রেলওয়ে পদ্মাসেতুতে ভালভাবে স্থান (মনে রাখতে হবে যমুনা বহুমুখী সেতুতে রেলওয়েকে যেনতেনভাবে শেষ মুহূর্তে স্থান দেয়া হয়েছিল) এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃতিলাভের সুযোগ পেয়েছে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ করে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে সংযোজিত হয়ে সহজগম্য রুটে পরিণত হয়েছে। আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো এই রেলওয়ে নেটওয়ার্কভুক্তিতে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যৌক্তিক পর্যায়ে উন্নীত করতে পারবেন।
আজ পদ্মা ব্রিজে রেলওয়ের অংশ উদ্বোধন হচ্ছে না, আশা করা যায় আগামী জুন’ ২০২৩ এর মধ্যেই সেটি (ঢাকা-ভাঙা সেকশন) চালু করা যাবে এবং জুন’ ২০২৪ এর মাঝে ভাঙা-যশোর সেকশন চালু হবে।
আমার ৩৬ বছর বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মজীবনের শেষ দেড় বছরের দায়িত্ব পালনে কয়েকটি বৃহৎ প্রকল্পের মধ্যে ‘পদ্মা ব্রিজে রেলওয়ে লিঙ্ক প্রকল্প’ এর সুপারভিশনের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছিল। রেলওয়ের উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ এ প্রকল্পে বরাদ্দ থাকায় প্রকল্প পরিচালক আমার বুয়েট ব্যাচমেট প্রকৌশলী ফকরুদ্দিন চৌধুরীর সাথে তটস্থ থাকতে হতো। মূল পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অগ্রজ বুয়েটিয়ান প্রকৌশলী মো: শফিকুল ইসলাম মহোদয়কে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই একাজ সম্পাদন করা এবং রেলওয়ে অংশে সহযোগিতার জন্য।
পদ্মা সেতুর মূল কাজ এবং মূল ব্রিজের সাথে রেলওয়ের কারিগরি বিষয়ে জটিলতা নিরসনে আমাদের মহান শিক্ষক এবং পদ্মা ব্রিজের ‘এক্সপার্ট প্যানেল’ প্রধান প্রয়াত অধ্যাপক ড: প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের কাছে জাতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। আমাকে বিভিন্ন সময়ে দেয়া তাঁর উপদেশ বিনতচিত্তে স্মরণ করছি। সেই সাথে বিশেষজ্ঞ কমিটির দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
সব শেষে, বিষয়টা শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে না, সার্বিকভাবে দেখতে হবে। যেমন আমদের ধমনীতে গাঁথা; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান না জন্মালে বাংলাদেশ নামক সার্বভৌম ভূখণ্ড পাওয়া যেত না, তেমনি দূঢ়চেতা-দূরদর্শী-চৌকস-মেধাবী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না হলে পদ্মা ব্রিজ হতো না। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।
জয় বাংলা, বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।
লেখক: রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক